Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

জগন্নাথপুর উপজেলার পটভূমি

১১৯১ খ্রিস্টাব্দে রাজা বিজয় মাণিক্য লাউড় রাজ্যের অধিপতি ছিলেন, রাজা বিজয় মাণিক্য তত্কালে জগন্নাথ মিশ্রকে দিয়ে বাসুদেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করান। পরে এই স্থানকে জগন্নাথ মিশ্রের নামানুসারে "জগন্নাথপুর" বলে ঘোষণা করেন। আর সেই থেকে জগন্নাথপুর, রাজা বিজয় মাণিক্যের রাজ্য বলে ঘোষিত। জগন্নাথপুরের পান্ডুয়া থেকে রাজা বিজয় মাণিক্য সেই সময় নিজ নিজ নামের সাথে দুই স্ত্রীর নাম সংযুক্ত করে ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে সিক্কা মুদ্রা প্রকাশ করেছিলেন। এই সিক্কা মুদ্রাই রাজা বিজয় মাণিক্যের রাজ্যের প্রমাণ, যা কুবাজপুর গ্রামের মদনমোহন চৌধুরীর পরিবারদের কাছে সংরক্ষিত আছে ।  জগন্নাথপুর এককালে বর্তমান ভৌগোলিক সীমানার চেয়ে আরো বড় ছিল। সেই দ্বাদশ শতাব্দি থেকে অষ্টাদশ শতাব্দি পর্যন্ত জগন্নাথপুর রাজ্য লাউড়ের শাখা-রাজ্য ছিল, এবং বংশানুক্রমে লাউড় নৃপতিগণ কর্তৃক শাসিত । দিল্লী সম্রাটদের রেকর্ডে জগন্নাথপুর রাজ্য লাউড়ের এজমালি সম্পদ হিসেবে বিবেচিত এবং শ্রীহট্রের ইতিহাসে বর্ণিত যে, উক্ত লাউড় রাজ্য সর্ব সময় মোগল সম্রাটদের কাছে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে গণ্য ছিল। তাই এই জগন্নাথপুর রাজ্যের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে প্রাচীন লাউড় রাজ্যের কথায় যেতে হয়। কারণ এর পত্তনস্থলই হচ্ছে প্রাচীন লাউড়। ঐতিহাসিকগণ বলেন, প্রাচীন লাউড়ের পত্তন সম্পর্ক মূলত প্রাচীন কামরূপ ।বৌদ্ধপরিব্রাজক হিউয়েঙ সাঙ কামরুপ রাজার আমন্ত্রনে (৬৪০ খ্রিস্টাব্দে) এদেশে ভ্রমণে এলে, সিলহেটকে কামরুপের অংশ বলে উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য, বিভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থাদিতেও সিলেটকে সমুদ্র নিকটবর্তী বলা হয়েছে। এছাড়া নিধনপুরে প্রাপ্ত তাম্রলিপি গুলোও তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ।


খ্রিস্টপূর্ব ত্রিশ শতাব্দিতে ভগদত্ত নামের জনৈক নৃপতি কামরূপে রাজত্ব করেছেন। তাঁর রাজ্য বিবরণে বলা হ্য় যে, তত্কালে লাউড়ের পাহাড়ে ভগদত্ত রাজার একটি শাখা-রাজধানী ছিল। তিনি যখনই এদেশে আসতেন সেখানেই অবস্থান করতেন এবং লাউড় থেকে দিনারপুর পর্যন্ত নৌকাযোগে ভ্রমণ করতেন। উপরে উল্লেখিত ঐতিহাসিক আলোচনায় প্রমাণ হ্য় যে, প্রাচীন শ্রীহট্র (বর্তমান সিলেটের) নিম্নাঞ্চল তখনকার যুগে গভীর পানির নিচে নিমজ্জিত ছিল। উল্লেখ্য, মহাভারত গ্রন্থের সভাপর্বে লিখিত: ভিম পন্ডু বঙ্গাদেশ জয় করিয়া তাম্রলিপ্ত এবং সাগরকুলবাসী স্লেচ্ছদিগকে জয় করেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে ভূতত্ত্ব বিষয়ের পন্ডিত বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গে প্রবেশাধিকারগ্রন্থে মহাভারতে উল্লেখিত বঙ্গ উত্তর-পূর্ব বঙ্গ দেশ অর্থে প্রাচীন লাউড় অঞ্চল বলেছেন। সুতরাং উল্লেখিত লাউড় তথা শ্রীহট্টই নয় বঙ্গ হতেও প্রাচীন। পুরাতাত্ত্বিক রমেশচন্দ্র দত্তের মতে, ব্রহ্মপুত্রের পরবর্তি কামরুপ রাজ্যের বিস্তৃতি প্রায় ২,০০০ মাইল। আসাম, মণিপুর, ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট, কাছার প্রভৃতি নিয়ে কামরূপ বিস্তৃত ছিল । সুতরাং এদিক দিয়ে বিবেচনায় প্রতিপাদ হয় যে, নৃপতি ভগদত্তের লাউড় রাজ্য মহাভারতকালের চেয়েও প্রাচীন। মহাকাব্য মহাভারতে প্রমাণ মিলে যে, রাজা ভগদত্ত কুরুক্ষেত্রের সমরে মহাবীর অর্জুন কর্তৃক নিহত হন। ভগদত্ত রাজার পরে তার পুত্রগণের মধ্যে ১৯ জন নৃপতি পর্যায়ক্রমে কামরূপ তথা লাউড়ে রাজত্ব করেন। ভাটেরায় প্রাপ্ত তাম্রফলকে বর্মান, ইশানদেব তাদেরই বংশধর বলে ব্রেতাগণ উল্লেখ করেছেন। এই রাজাগণ চন্দ্রবংশীয় বলে খ্যাত । উক্ত ১৯ জন নৃপতির অনেকদিন পরে প্রাচীন লাউড় রাজ্যে নৃপতি বিজয়মাণিক্য আবির্ভুত হন। ১১৯১ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে বিজয় মাণিক্য জগন্নাথপুর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং ছিক্কা মুদ্রার প্রচার করেন ।


অন্যদিকে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে ইয়ামনদেশীয় তাপস হযরত শাহ জালাল মুজারর্দ (রঃ) তিনশত ষাটজন সঙ্গিঅনুসারী নিয়ে প্রাচীন শ্রীহট্রের গৌড় জয় করেন । শাহ জালাল (রঃ) এর সঙ্গীঅনুসারিগণ ইসলামের পবিত্র বাণী নিয়ে শ্রীহট্রসহ বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়েন । তারই ধারাবাহিকতায় হযরত শাহ জালাল (রঃ) এর সঙ্গীঅনুসারিগণদের মধ্য হতে পর্যাক্রমে আট জন আউলিয়া জগন্নাথপুর রাজ্যে এসেছেন বলে শোনা যায়


পর্যাক্রমে আগত আউলিয়াগণের নাম ও বর্তমানে অবস্থিত মাঝার:- শাহ কালাম - শাহার পাড়ায়, সৈয়দ শামস্ উদ্দীন - সৈয়দপুর গ্রাম, শাহ কালু ও শাহ চান্দ- মিরপুর - দাওর বকস্ খতিব - দাউরাই গ্রাম, শাহ ফেছন উদ্দীন - ফেছি গ্রাম, সৈয়দ সামস্ উদ্দীন বিহারি আট গাও, শাহ মাণিক - মনিহারা গ্রাম। উল্লেখ যে, মিরপুরে অবস্থান রত শাহ চান্দ পরবর্তিতে চান্দ ভরাং গ্রামে ছলে যান এবং সেখানেই বর্তমানে তাঁর মাঝার অবস্থিত । উল্লেখিত বিজয় মাণিক্য অনেক কাল পরে লাউড় ও জগন্নাথপুর রাজ্যে দিব্য সিংহ নামে নৃপতি রাজত্ব করেন । তখন লাউড়ের রাজধানী নবগ্রামে স্থানান্তর হ্য়। যে নবগ্রাম বৈষ্ণবী ধর্মাবতার অদ্বৈত্য'র জন্মস্থান বলে আখ্যায়িত। রাজা দিব্য সিংহ রাজ্যভার তাঁর পুত্র রমানাথকে দিয়ে, শান্তি সাধনায় তিনি তাঁর মন্ত্রীতনয় অদ্বৈত্যের আখড়া শান্তিপুরে চলে যান। সেখানে থেকে অদ্বৈত্যের উপদেশে বৈষ্ণবীধর্ম গ্রহণ করেন এবং অদ্বৈত্য বাল্যলিলা গ্রন্থ রচনা করে কৃষ্ণদাস নামে খ্যাত হন। রাজা দিব্য সিংহের পুত্র রামানাথ সিংহের তিন পুত্র হয়। এই তিন পুত্রের মধ্যে একজন কাশীবাসি হন এবং এক পুত্রকে লাউড়ের রাজ সিংহাসনে বসিয়ে; রামানাথ সিংহ তাঁর অন্য পুত্র কেশবের সাথে জগন্নাথপুরে আসেন। প্রায় পঞ্চদশ শতাব্দির কালে রামানাথের পুত্র কেশব সিংহ তথায় রাজা হন। উল্লেখ্য যে, এসময়ে আজমিরীগঞ্জ এলাকায় বানিয়াচঙ্গে অন্য একটি নবরাজ্যের আর্বিভাব ঘটে। এই নব্য আবিষ্কৃত রাজ্যের রাজার নামও কেশব ছিল। অচুত্যচরণ চৌধুরী লিখেছেন যে, "নব্য আবিস্কৃত বানিয়াচং রাজ্যের রাজার নাম এবং জগন্নাথপুর রাজ্যের রাজার নাম এক থাকায়, অনেক লেখক ভ্রমে পতিত হয়ে জগন্নাথপুর ও বানিয়াচঙ্গের রাজ পরিবারকে এক বংশের বলে যেভাবে আখ্যায়িত করেন, আসলে এরা এক নন। বানিয়াচং রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কেশব একজন বণিক ছিলেন। তিনি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এদেশে এসেছিলেন এবং কালী নামের দেবির পুজা নির্বাহের লক্ষ্যে দৈব্যে শ্রুত শুষ্কভূমির সন্ধান প্রাপ্ত হয়ে সেখানে অবতরণ করে দেবি পুজা সমাধান করে দৈবাভিপ্রায় মতে সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। এছাড়া জগন্নাথপুর রাজ্যের কেশব রাজার পুত্রের নাম শনি, তার পুত্র প্রজাপতি, প্রজাপতির পুত্র দুর্বার । অন্যদিকে বানিয়াচঙ্গের কেশব রাজার পুত্রের নাম দক্ষ, দক্ষের পুত্র নন্দন ইহার পুত্র গণপতি ও কল্যাণ। সুতরাং ইহাদের বংশিয় ধারায় ও ইহা প্রতিপাদিত হয় যে, জগন্নাথপুরের কেশব ও বানিয়াচঙ্গের রাজা কেশব দুই ব্যক্তি, ওরা এক নন।"

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া