Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব

রাধারমণ দত্ত 


 (জন্ম-১৮৩৩ খ্রি:, ১২৪০ বঙ্গাব্দ, মৃত্যু- ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ, ১৩২২ বঙ্গাব্দ) 

বাংলা লোকসংগীতের পুরোধা লোক কবি রাধারমণ দত্ত। তাঁর রচিত ধামাইল গান সিলেট ও ভারতে বাঙ্গালীদের কাছে পরম আদরের ধন। রাধারমন নিজের মেধা ও দর্শনকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। কৃষ্ণবিরহের আকুতি আর না পাওয়ার ব্যথা কিংবা সব পেয়েও না পাওয়ার কষ্টতাকে সাধকে পরিণত করেছে। তিনি দেহতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, অনুরাগ, প্রেম, ভজন, ধামাইলসহ নানা ধরণের কয়েক হাজার গান রচনা করেছেন। কবি রাধারমণের পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উপাসনার প্রধান অবলম্বন সংগীতের সংগে তাঁর পরিচয় ছিল শৈশব থেকেই। খ্যাতিমান লোককবি জয়দেবের গীত গৌবিন্দ এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন তার পিতা রাধামাধব দত্ত। পিতার সংগীত ও সাহিত্যসাধনা তাকেও প্রভাবিত করেছিল। ১২৫০ বঙ্গাব্দে রাধারমণ পিতৃহারা হন এবং মা সুবর্ণা দেবীর কাছে বড় হতে থাকেন। ১২৭৫ বঙ্গাব্দে মৌলভীবাজারের আদপাশা গ্রামে শ্রী চৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ সেন শিবানন্দ বংশীয় নন্দকুমার সেন অধিকারীর কন্যা গুণময়ী দেবীকে বিয়ে করেন। পিতার রচিত গ্রন্থগুলো সে সময় তাঁর জন্যপিতা আদর্শহয়ে অন্তরে স্থান করে নিল। কালক্রমে তিনি একজন স্বভাব কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। রচনা করেন হাজার হাজার বাউল গান । লিখেছেন কয়েকশ ধামাইল গান। ধামাইল গান সমবেত নারী কন্ঠে বিয়ের অনুষ্ঠানে গীত হয়। বিশেষত সিলেট, কাছাড়, ত্রিপুরা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে একসময় এর প্রচলন খুব বেশি ছিল। রাধারমণ দত্ত একাধারে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী ছিলেন। জানা যায়, সাধক রাধারমণ দত্ত ও মরমি কবি হাসন রাজার মধ্যে যোগাযোগ ছিল। অন্তরের মিল ছিল খুব বেশী। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন সময় পত্রালাপ হতো কবিতায়। একবার হাসন রাজা রাধারমণের কুশল জানতে গানের চরণ বাঁধেন: রাধারমণ তুমি কেমন, হাছন রাজা দেখতে চায়। উত্তরে রাধারমণ লিখেনঃ কুশল তুমি আছো কেমন - জানতে চায় রাধারমণ। রাধারমণ একজন কৃষ্ণ প্রেমিক ছিলেন। কৃষ্ণবিরহে তিনি লিখেছেন অসংখ্য গান। তিনি বাল্যাবধি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ও ধর্মানুরাগী ছিলেন। শাস্ত্রীয় পুস্তকাদির চর্চা ও সাধু সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে এসে তিনি শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি নানা মত ও পথের সঙ্গে পরিচিত হন। কবির সংসার জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্যপাওয়া যায়নি। শুধু জানা যায় রাধারমণ-গুণময় দেবীর ৪ ছেলে ছিল। তাঁদের নাম- রাজ বিহারী দত্ত, নদীয়া বিহারী দত্ত, রসিক বিহারী দত্তও বিপিন বিহারী দত্ত। কিন্ত দুঃখের বিষয় একমাত্র পুত্র বিপিনবিহারী দত্ত ছাড়া বাকি ৩ পুত্র এবং স্ত্রী গুণময় দেবী অকালে মারা যান। স্ত্রী ও পুত্রদের পরলোক গমনে কবি রাধারমণ দত্তসংসার জীবন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন। ১২৯০ বঙ্গাব্দে ৫০ বছর বয়সে কবি চলে যান মৌলভীবাজার জেলাধীন ঢেউপাশা গ্রামে সাধক রঘুনাথ ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি তাঁর কাছে শিষ্যত্ব লাভ করেন। শুরু হয় কবির বৈরাগ্য জীবন। আরম্ভ করেন সাধনা। গৃহত্যাগ করে জগন্নাথপুর উপজেলার নলুযার হাওরের পাশে একটি আশ্রম তৈরি করেন। এখানে চলে তাঁর সাধন। নলুয়ার হাওরের আশ্রমে দিবা রাত্র সাধনা ও ইষ্টনামে মগ্ন এবং অসংখ্য ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। ধ্যান মগ্ন অবস্থায় তিনি গান রচনা করে গেয়ে যেতেন। ভক্তরা শুনে শুনে তা স্মৃতিতে ধরে রাখত এবং পরে তা লিখে নিত।

 

আব্দুস সামাদ আজাদ 

(জন্ম- ১৫ জানুয়ারী ১৯২৬ খ্রি:, মৃত্যু: ২৭ এপ্রিল ২০০৫)

আলহাজ্ব আব্দুস সামাদ আজাদ ১৯২৬ সা লের ১৫ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার দুর্গম অজ-পাড়া গাঁ, চর্তুদিকে হাওর বেষ্টিত ভুরাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম মোহাম্মদ শরিয়ত উলাহ। সামাদ আজাদ শরিয়ত উলাহর দ্বিতীয় পুত্র। সামাদ আজাদ প্রথমে গ্রামের স্কুলে ও পরে দিরাই উপজেলার জগদল ভাটিরগাঁও স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। ১৯৪৩ সালে সুনামগঞ্জ শহরের সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। তিনি যখন সুনামগঞ্জ সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র অর্থাৎ ১৯৪০ সালে সামাদ আজাদ সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি হিসাবে ছাত্র রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। ১৯৪৮ সালে সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ) থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও ইতিহাস বিষয়ে তিনি এম এ পাশ করেন। তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণে সরকার তার এম এ ডিগ্রি কেড়ে নেয়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং আসাম অঞ্চলের বিভিন্ন আঞ্চলিক বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সংগ্রামের সাথে সামাদ আজাদ সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এ কারণে ইংরেজ শাসক কর্তৃক গ্রেফতার ও নির্যাতনের স্বীকার হন এবং তার প্রথম কারা জীবন শুরু হয়। ১৯৪৪-৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনেও রয়েছে এ রাজনীতিবিদের সুদীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করতে গিয়ে কারা বরণ করেন। ১৯৫৩ সালে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যনির্বাচিত হয়ে রাজনীতির লাইম লাইটে আসেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্তপূর্বপাকিস্তান (বাংলাদেশ) আওয়ামীলীগের শ্রম সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন। ১৯৫৬ সালে সমগ্রপূর্বপাকিস্তান ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়ায় পাক সাময়িক সরকার পুনরায় তাকে আটক করে কারাগারে পাঠায়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারীর পর তিনি আবার গ্রেফতার হন এবং ৪ বছর কারাভোগ করে ১৯৬২ সালে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃ ক সৃষ্টষড়যন্ত্রমূলক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করতে গিয়ে কারারূদ্ধহন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্যনির্বাচিত হন তিনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের মনোনয়নে তিনি সুনামগঞ্জ জেলার ২ ও ৩নং আসন জগন্নাথপুর-দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-৩ আসন এবং দিরাই-শাল-া-ধর্মপাশা ও জামালগঞ্জ-২, দুটি আসনে নির্বাচন করে সংসদ সদস্যনির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার (স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার) প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের মধ্যেতিনি ছিলেন অন্যতম। বাঙালী জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্তআত্যান্তভাজন ব্যক্তিত্ব জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ ছিলেন মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা (পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা) এবং ভ্রাম্যমান রাষ্ট্রদূত। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সামাদ আজাদ বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বপান। ১৯৭১ সালের হাঙ্গেরি বুদাষ্টেবিশ্বশান্তিসম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন এবং বিশ্ববর্ণবৈষম্যকমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয়উপনেতার দায়িত্বপালন করেন। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে আওয়ামীলীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বপুনরায় পান। ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই দলের মনোনয়নে সংসদ সদস্যনির্বাচিত হন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তিনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্বপালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। ৭৫ পরবর্তী অন্ধকারাচ্ছন্ন জাতীয় রাজনীতির পট পরিবর্তনের সময় তিনি ছিলেন নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচল। দীর্ঘদুর্ভোগ, জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতনের হুলিয়া মাথায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে র অসাম্প্রদায়িক চেতনার সূর্যসন্তান হিসেবে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন।

 

সুহাসিনী দাস

(জন্ম ১লা ভাদ্র ১৩২২ (বঙ্গাব্ধ) - মৃত্যু মে ২৫, ২০০৯)

বাংলাদেশী নারী সংগঠক যিনি বৃটিশ বিরোধী এবং ভারতের স্বাধীনতা অন্দোলনের পূর্ব বাংলায় বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেন।

সুহাসিনী দাস সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম প্যারীমোহন রায় ও মায়ের নাম শোভা রায়। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে সিলেট শহরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কুমুদ চন্দ্র দাসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের চার বছরের মধ্যেই তার স্বামীর মৃত্যু হয়। এর কিছুদিন পরই তিনি প্রথমে সমাজসেবা ও পরে রাজনীতিতে সক্রিয় হোন। শ্বশুড়ের পরিবার থেকে প্রাপ্ত অঢেল সম্পত্তির খুব সামান্য নিজের খরচের জন্য রেখে বাকি সব সম্পত্তি জণকল্যাণমূলক কাজে বিলিয়ে দিয়েছেন।

‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু হলে ১৯৪২ সালে সুহাসিনী দাসকে কারাগারে যেতে হয়। তিনি ১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেন। সুহাসিনী দাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেরও সংগঠক। ১৯৪৭ সালে কুলাউড়ার রঙ্গিরকুল পাহাড়ে কংগ্রেস কর্মীরা একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দুর্যোগময় দিনগুলোতে তিনি তার বিচক্ষণতা দিয়ে আশ্রমটিকে রক্ষা করেন। পাকবাহিনী যখন গণহত্যা চালাচ্ছিল তখন সুহাসিনী দাস রঙ্গিরকুল আশ্রমে থেকে মানুষের সেবা করেন। বেশ কয়েকবার পাকবাহিনী আশ্রমে হামলা চালালেও প্রতিবারই তিনি আশ্রম ও নিজেকে রক্ষা করেন। স্বাধীনতার পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে যুক্ত হন সমাজসেবায়। বিশেষ করে নারীদের স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে পালন করেন বিশেষ ভূমিকা। ১৯৭৩ সালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে সংবর্ধিত হন। সমাজসেবায় গুরুত্ত্বপূর্ণ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৬ সালে সুহাসিনী দাসকে রাষ্ট্রীয় ‘সমাজসেবা’ পুরস্কার দেওয়া হয়।